An Inspirational Story: Dream Beneath the Blue Sky
অধ্যায় ১: শৈশবের মাধবপুর
সবুজে মোড়া ছোট্ট গ্রাম মাধবপুর। চারপাশে ধানক্ষেতের সমারোহ, মাঝে মাঝে তালগাছের সারি, আর দিগন্ত ছোঁয়া খোলা আকাশ। গ্রামের এক প্রান্তে কাঁচা রাস্তার ধারে মাটির তৈরি একটি ঘর—সেখানেই থাকে সুমি।
সুমি তখনো ছোট, কিন্তু চোখে-মুখে আশ্চর্য এক কৌতূহল। বাবা দিনমজুর, মা গৃহিণী। সংসার খুব সচ্ছল নয়। অনেক সময় রাতের ভাতও জোটে না। তারপরও পরিবারের সবাই মিলে ছোট ছোট খুশি খুঁজে নেয়।
সকালে পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙে সুমির। মা ডাকেন—
ও সুমি, ওঠ মা, তোর স্কুলে যাবি না?
সুমি ঘুম জড়ানো চোখ মেলে উত্তর দেয়,
যাবো মা, তবে আগে তোমাকে কাজে সাহায্য করি।
সে মায়ের সঙ্গে হাঁড়ি-পাতিল ধোয়, খড়কুটো জোগাড় করে। তারপর পুরোনো কাপড়ের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলের পথে পা বাড়ায়।
গ্রামের স্কুলটা খুব বড় নয়। টিনের চালা, মাটির মেঝে, বাঁশের বেঞ্চ। কিন্তু শিক্ষকদের ভালোবাসা আর যত্নে সেটি যেন এক আশ্রয়স্থল। সুমির পড়াশোনার আগ্রহ দেখে শিক্ষকরা প্রায়ই অবাক হন। অনেকের কাছে বই-পত্র না থাকলেও, সুমি প্রতিদিন লেগে থাকে পড়ার টেবিলে।
গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েরা যখন মাঠে খেলতে ব্যস্ত, তখন সুমি বসে থাকে বই নিয়ে। বন্ধুরা হাসাহাসি করে, তুই না খুব বড় মানুষ হবি! কিন্তু সুমি হাসিমুখে জবাব দেয়
বড় মানুষ হবো না, মানুষকে সাহায্য করার মতো মানুষ হবো।
গ্রামের লোকেরা এ কথা শুনে অবাক হয়। তাদের কাছে পড়াশোনার মানে ছিল চাকরি পাওয়া, সংসার চালানো। কিন্তু সুমির মনে ছিল অন্য কিছু। তার চোখে স্বপ্ন—একদিন সে গ্রামের মানুষদের কষ্ট দূর করবে।
অধ্যায় ২: প্রতিকূলতার দেয়াল
সময় গড়ায়। সুমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। হঠাৎ করেই নেমে আসে ঝড়। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাঠে আর কাজ করতে পারেন না। সংসারের একমাত্র উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়।
মা তখন লোকের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন। সকালে ভোরে বের হন, দুপুরে ফিরে আসেন ক্লান্ত শরীরে। ঘরে খাবার জোটে খুব সামান্য। অনেক সময় খালি পেটে থাকতে হয়।
এমন অবস্থায় গ্রামে আলোচনা শুরু হয়—
এত কষ্টের মধ্যে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে কী লাভ?
মেয়েদের কি আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হয় নাকি? কাজ শিখুক, সংসার সামলাক।
একদিন গ্রামের এক বৃদ্ধা এসে মাকে বলল,
বউমা, মেয়ে তো বড় হলো। এখন আর স্কুলের দরকার কী? একটু সেলাই শিখুক, কাজ শিখুক।
মা চুপ করে রইলেন। কিন্তু সুমি পাশে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
না ঠাকুমা, আমি স্কুল ছাড়বো না। আমি পড়বো।
বৃদ্ধা হেসে মাথা নাড়লেন। হয়তো মনে মনে ভাবলেন—গ্রামের গরিব মেয়ে এত সাহস কোথায় পায়!
সেই রাতে মা সুমিকে কোলে টেনে নিলেন। বললেন,
মা, তুই কি সত্যিই এত কষ্ট সহ্য করতে পারবি?
সুমি চোখ মুছে উত্তর দিল,
মা, আমি কষ্টকে ভয় পাই না। যদি আমি এখন পড়াশোনা ছেড়ে দিই, তবে আমরা কোনোদিন এই অন্ধকার থেকে বের হতে পারবো না।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানেন মেয়েটি জেদি, কিন্তু সেই জেদের মধ্যেই ভবিষ্যতের আলো লুকিয়ে আছে।
অধ্যায় ৩: মায়ের সাহস, মেয়ের জেদ
সুমি ক্লাস নাইনে ওঠে। সংসারের অবস্থা তখনো খারাপ। বই কেনার টাকা নেই। অনেক সময় খাতার অভাবে পুরোনো কাগজে লিখতে হয়। কিন্তু পড়াশোনার আগ্রহে কোনো ভাটা পড়ে না।
একদিন স্কুলে শিক্ষকরা ঘোষণা দিলেন—এবার থেকে যে ভালো করবে, সে পাবে বৃত্তি। সুমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যেভাবেই হোক বৃত্তি তাকে পেতেই হবে।
দিন-রাত সে পড়াশোনায় লেগে থাকে। মায়ের কাছে কেরোসিন তেল চায়, যাতে রাতে বাতি জ্বালাতে পারে। মা অনেক সময় না খেয়েই টাকা জমিয়ে দেন, শুধু মেয়ের পড়াশোনার জন্য।
একদিন সন্ধ্যায় মা কাজ শেষে বাড়ি ফিরলেন। হাতে কিছু টাকা। সুমি জিজ্ঞেস করল, মা, এত টাকা কোথায় পেলে?
মা হাসিমুখে বললেন,
“আজ এক বাড়িতে বাড়তি কাজ করেছিলাম। ভেবেছি তোর বই কিনে দেব।
সুমি মায়ের হাত শক্ত করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
মা, তুমি না খেয়ে থেকো না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, একদিন তোমার সব কষ্ট দূর করবো।
সেই বছর পরীক্ষায় সুমি প্রথম হয়। বৃত্তিও পায়। হাতে যখন টাকার খামটা তুলে দেওয়া হলো, সুমি মনে মনে বলল—
এটা শুধু কাগজ নয়, এটাই আমার স্বপ্নের চাবিকাঠি।
অধ্যায় ৪: অন্ধকারে আলো খোঁজা
সুমির বয়স তখন ষোলো। গ্রামে তখন বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। স্কুলে আয়োজন করা হলো প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা। বিষয় আমার স্বপ্ন।
ছাত্রছাত্রীরা কেউ ডাক্তার হতে চাইলো, কেউ শিক্ষক, কেউবা চাকরিজীবী। কিন্তু সুমি লিখলো—
আমি ডাক্তার হতে চাই। আমি চাই আমার গ্রামে আর কোনো মানুষ যেনো চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়। আমি চাই, গরিবরা যেনো হাসিমুখে ডাক্তারখানায় আসতে পারে। আমি চাই, গ্রামের মানুষের চোখে ভরসা ফিরুক।
প্রবন্ধটি শুনে পুরো হলঘর নিস্তব্ধ হয়ে যায়। প্রধান শিক্ষক চোখ মুছে বললেন,
এই মেয়েটা একদিন সত্যিই বড় হবে। আমাদের গ্রামের গর্ব হবে।
সেদিন থেকেই গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে সুমিকে নতুন চোখে দেখতে শুরু করলো। যদিও অনেকে তখনো হাসাহাসি করতো—গরিবের মেয়ে ডাক্তার হবে? এটা কি কখনো সম্ভব?
কিন্তু সুমি জানত, মানুষের কথা শোনার জন্য সে জন্মায়নি। সে জন্মেছে নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য।
অধ্যায় ৫: কাঁটায় ভরা পথ
এইচএসসি ক্লাসে ওঠার পর সুমির জীবন আরও কঠিন হয়ে গেল। বাবার অসুখ ততদিনে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। চিকিৎসার জন্য টাকার অভাবে অনেক সময় ঔষধও কেনা সম্ভব হতো না। মা কাজ করতে করতে ভেঙে পড়ছিলেন।
এই অবস্থায় সুমি সিদ্ধান্ত নিলো, পড়াশোনার পাশাপাশি সে টিউশনি করবে। গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু করলো। মাস শেষে অল্প কিছু টাকা পেত, আর সেই টাকা দিয়েই নিজের খাতা-কলম কিনতো।
ক্লাসের বন্ধুরা যখন টিফিনে সমোসা, চিপস খেত, তখন সুমি চুপচাপ বসে থাকত। তার কাছে খাবার কেনার মতো টাকা থাকতো না। বন্ধুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত,
তুই কিছু খাস না কেন?
সুমি হেসে বলত,
আমার ক্ষুধা লাগে না।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। ক্ষুধা লাগলেও খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তবুও সে মন ভেঙে পড়তে দিত না। রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের পাশে বসে বলতো,
মা, একটু ধৈর্য ধরো। খুব শিগগিরই আমাদের দিন বদলাবে।
এইচএসসি পরীক্ষার সময়েও এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। বাবার অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। অনেকেই বললো, পরীক্ষায় বসার দরকার নেই। বাবার পাশে থাকতে হবে।
কিন্তু বাবা সুমির হাত ধরে বললেন,
মা, আমি হয়তো বাঁচবো না। কিন্তু তুই যদি পরীক্ষায় না বসিস, তবে আমার চোখ বুজবে না। তুই ডাক্তার হবি, এইটাই আমার শেষ ইচ্ছা।
চোখের জল মুছে সুমি পরীক্ষায় বসল। অদ্ভুত শক্তি যেন তাকে ভর করলো। প্রতিটি খাতায় নিজের মনের সমস্ত জেদ উজাড় করে লিখলো।
অধ্যায় ৬: জয় অথবা পরাজয়
এইচএসসি পাশ করার পর এলো সবচেয়ে কঠিন সময়—মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। গ্রামের অনেকেই বললো,
এই মেয়ে কি আর ডাক্তার হতে পারবে? শহরে গিয়ে পড়াশোনা করার সামর্থ্য কি আছে ওর?
কিন্তু সুমি নিরাশ হলো না। টিউশনি থেকে জমানো টাকা, শিক্ষকদের সাহায্য, আর মায়ের অশেষ ত্যাগে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করলো।
পরীক্ষার আগের রাত। ঘরে কেরোসিনের বাতি নিভে আসছে। সুমি শেষবারের মতো বই খুলে বসলো। মা পাশে বসে হাত বুলিয়ে বললেন,
মা, তুই যদি না-ও পারিস, কোনো দুঃখ নেই। তুই চেষ্টা করেছিস, এটাই সবচেয়ে বড়।
সুমি মৃদু হেসে উত্তর দিল,
না মা, আমি পারবো। আমি তোদের মুখ উজ্জ্বল করবই।
পরীক্ষার দিন সকালে মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়লেন। সুমি কক্ষের ভেতরে ঢুকে মনে মনে বাবার কথা স্মরণ করলো তুই ডাক্তার হবি।
কয়েক সপ্তাহ পর ফলাফল বের হলো। সেদিন গ্রামে এক উৎসবের আমেজ। প্রধান শিক্ষক নিজেই দৌড়ে এসে বললেন,
সুমি! তুই সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছিস!
মায়ের চোখ ভিজে গেল। তিনি মাটিতে বসে কেঁদে ফেললেন। পুরো গ্রাম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। যে মেয়েটি ছেঁড়া জামা পরে স্কুলে আসতো, আজ সে ডাক্তার হওয়ার পথে!
Comments
Post a Comment